কি করে মামুন কম্পিউটার শেখা শুরু করল জানতে চাইলে বিপাশ জানান, ‘গত ফেব্রুয়ারী মাসে মামুন পল্লীতথ্য কেন্দ্রে এসে আমার কাছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ভর্তি ফরম চায়। আমি তখনো জানতাম না মামুনের দুটি হাতই নেই। যখন তাকে একটি ভর্তি ফরম পূরণ করার জন্য দেই তখন মামুন জানায় তার হাত নেই কিন্তু খুব কম্পিউটার শেখার আগ্রহ রয়েছে। এক পর্যায়ে তাকে ল্যাবে নিয়ে গিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসাই। যখন দেখলাম মামুন তার আধখান হাত দিয়ে মাউস ধরেছে এবং নাড়াচাড়া শুরু করে দিয়েছে তখনই বুঝতে পারলাম সে কম্পিউটার চালাতে পারবে। তাকে বললাম, তোমাকে বিনামুল্যে কম্পিউটার শিখানো হবে। এর পর থেকে মামুনের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ শুরু।’
দু‘হাত নেই তবুও কম্পিউটার নিজের বশে এনেছে মামুন। গত দুই মাসে ফটোশপ ব্যবহার করে ছবি সম্পাদনা এবং এমএস ওয়ার্ড ব্যবহার করে শব্দ প্রক্রিয়াজাতকরণ করার কাজ শিখেছেন তিনি।
ফটোশপে ছবি সম্পাদনার সময় মামুনকে জিজ্ঞেস করি, যদি মাউসের পাশাপাশি কীবোর্ডের কোন চাবি চাপার প্রয়োজন হয় তাহলে কি করেন? মুখের কথা শেষ না হতেই মামুন তার থুতনি দিয়ে শিফট চাবি চেপে ধরে এবং মাউস টানা শুরু করে দেয়। পাশে দাঁড়ানো রোজ বলল, কম্পিউটারে তো “অন স্ক্রিন কীবোর্ড” রয়েছে। সেটা ব্যবহার করলেতো আর এত কষ্ট হবে না। তাৎক্ষণিকভাবেই মামুন জানতে চায়-‘কোথায়?’ আমাদের বলার সাথে সাথে মামুন মাউস চেপে চেপে অন স্ক্রিন কীবোর্ড বের করে ফেলে এবং ‘দারুন তো!’ বলে নিজে নিজেই আবিস্কার করে ফেলেন ‘হোবার বাটন সেটিং’ এর মাধ্যমে খুব সহজেই কীভাবে পর্দায় দৃশ্যমান কীবোর্ডের ছবির ওপর মাউস বুলিয়েই টাইপ করা যায়। বুঝতে পারলাম, দ্রুত শেখার ক্ষমতা মামুনের অসাধারণ।
মামুনের ইচ্ছে নিজের যদি একটি কম্পিউটার থাকতো তাহলে বাড়িতে বসেই অন্য প্রোগ্রামগুলো শিখতে পারতো এবং দু’হাতের বদলে দু’পা দিয়ে কীবোর্ড চালাতো। ক্লাশে বসে পা দিয়ে চর্চা করার মতো পরিবেশ মামুন পায় না।
মামুনের পুরো নাম মামুন হোসেন। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের আবুল হোসেনের ছোট ছেলে। দু’হাত নেই তবুও তার প্রবল ইচ্ছা কম্পিউটারের সকল প্রোগ্রাম তিনি শিখবেন। একটি দোকান দিয়ে সংসার চালাবেন।
মামুন জানান, ১৯৯২ সালে তার জন্ম। ৫ম শ্রেণীতে পড়ার সময় দুষ্টুমির ছলে বিদ্যুতের খুঁটিতে উঠতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। এর পর দু হাত নষ্ট হয়ে যায়। গরীব বাবা ভিটে-বাড়ি বিক্রি করেও ছোট ছেলে মামুনের হাত দুটি ভালো করতে পারেননি। বরং শরীর থেকে হাত দুটি কেটে ফেলতে হয়েছে। এর পর থেকে মামুনের আর লেখা পড়া হয়নি। তবুও তিনি মুখ দিয়ে কলম ধরে লেখা শিখেছেন। তার মনে ভীষণ ইচ্ছা জাগে নিজের হাত নেই তার পরেও কম্পিউটার শিখবেন। ৪ ভাই ১ বোনের মধ্যে মামুন সবার ছোট। বাবা কম্পিউটার শিখতে আসার গাড়ি ভাড়া পর্যন্ত দিতে পারেন না।
গত মাসে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় মামুনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। প্রশিক্ষণের শেষ দিনে সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। সনদ বিতরণের পূর্ব পর্যন্ত কেউ জানেন না কার হাত থেকে সনদ নিতে যাচ্ছেন প্রশিক্ষণার্থীগণ। হঠাৎ করেই উপস্থিত সুধীজন দেখতে পান একজন প্রতিবন্ধী এবং একটি শিশু আমার পাশে বসে আছেন। অনেকেই ভাবছেন অনুষ্ঠান শুরু হতে আর কত বাকী? অতিথিগণ কখন আসবেন? আচমকা ঘোষণা করা হয় আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মামুন এবং বিশেষ অতিথি ২য় শ্রেণীর ছাত্রী জারিনের কাছ থেকে সকলে সনদ নিতে যাচ্ছেন। একজন তথ্যকর্মী বলে ওঠলেন- ‘একটা নতুন জিনিস শিখলাম’। এমনি পরিবেশে খুবই আনন্দের সাথে মামুনের হাত থেকে সনদ গ্রহণ করলেন তথ্যকর্মীগণ।
খুব বেশি কথা বললেন না মামুন। শুধু এটুকুই বললেন, ‘সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখছে তা বাস্তবায়নের জন্য একজন প্রতিবন্ধী হলেও আমি অবদান রাখতে চাই। আমি একটি কম্পিউটার পেলে সারাদিন চর্চা করব এবং আমার মতো অন্যান্য প্রতিবন্ধীদেরকে শেখাবো। প্রতিবন্ধীরাও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারে।’ মামুনের স্বপ্ন পুরন হবে এ প্রত্যাশা নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি।
0 comments:
Post a Comment