২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করে একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারাবদ্ধ সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে কিছুদিন আগে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার এই এক বছরের বিভিন্ন কার্যক্রম বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন এবং ২০১০-এ সরকারের কাছে চাওয়া নিয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরাম (বিআইজেএফ)। শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে বক্তারা গত এক বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অগ্রগতি এবং বিভিন্ন পদক্ষেপের আলোচনা-সমালোচনা করেন। বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য ড. আকরাম চৌধুরী। এছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মোস্তফা জব্বার, সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান স্বপন, আইএসপি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আখতারুজ্জামান মঞ্জু, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার ইনফরমেশন সার্ভিস-এর ওয়ার্কিং গ্রুপের চেয়ারম্যান হাবিবুল্লাহ করিম, বাংলাদেশ ওপেনসোর্স নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে কবির শিহাব, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট তারেক বরকতুল্লাহসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং বিভিন্ন ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বৈঠকে বক্তব্য রাখেন।
উপস্থিত অধিকাংশ বক্তারা ‘দেশ ডিজিটালের দিকে এগোচ্ছে এবং গত বছরের তথ্য-প্রযুক্তি খাতের অগ্রগতি আশাব্যাঞ্জক’ বলে মত প্রকাশ করেছেন। নকিয়ার কমিউনিকেশন ম্যানেজার মৌটুসী কবির তার বক্তব্যে বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে সবার আগে যেটা প্রয়োজন তা হলো সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। আর গত এক বছরে সত্যিই প্রচুর সংখ্যক মানুষ ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন এবং তারা তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।’ তবে বাংলাদেশে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরির উপর গুরুত্ব দেয়া উচিৎ বলে মত প্রকাশ করেন তিনি। কেননা, উন্নত বিশ্বে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের একটি বিশাল মার্কেট রয়েছে যাতে বাংলাদেশি যুব সমাজ সুযোগের অভাবে অংশ নিতে পারছে না। তার কথার সঙ্গে একমত হন বৈঠকে উপস্থিত গ্রামীণফোনের কমিউনিটি ইনফরমেশন সেন্টার (সিআইসি)-এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সুলতানুর রেজা। তার মতে, সকল স্তরের মানুষের হাতের নাগালে প্রযুক্তি তথা ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে মোবাইল ফোন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের জন্য অ্যাপ্লিকেশন তৈরিরও একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র রয়েছে বলে তার অভিমত।
তবে বৈঠকে ডিজিটাল বাংলাদেশের এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে সমালোচিত বিষয়টি হচ্ছে সমন্বয়হীনতা। বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্কের সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ উদ্দীন আকবর বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মন-মানসিকতা তৈরি হয়েছে ঠিকই, তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় কোনো সমন্বিত প্রচেষ্টা নেই। তিনি জানান, সবকিছু প্রযুক্তিনির্ভর করার কার্যক্রম এগিয়ে চলছে ঠিকই, তবে এখন পর্যন্ত তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছেনি। তার সঙ্গে একমত হয়ে অনেক বক্তারাই বলেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় প্রয়োজন সম্মিলিত কার্যক্রম। আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন জেলায় টেলিসেন্টার বা সাইবার ক্যাফে গড়ে না তুলে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর একসঙ্গে বসে আলোচনা করে তারপর সমন্বিতভাবে তৃণমূল পর্যায়ে ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়ার কাজ করা উচিৎ বলে অভিমত অনেকেরই।
এছাড়াও বক্তারা সম্প্রতি ৬৪টি জেলার ওয়েবসাইট উদ্বোধন, পাঠ্যবই ইন্টারনেটে সহজলভ্য করে দেয়াসহ প্রভৃতি কার্যক্রমের প্রশংসা করেন।
তবে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মোস্তফা জব্বারের মতে, গত এক বছরে দেশে ডিজিটাল খাতে যা যা উন্নতি হয়েছে বা দেশ এই ক্ষেত্রে যতদূর এগিয়েছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রম হাতে না নিলেও তা এমনিতেই হতো। তিনি অভিযোগ করেন, এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও সরকার কর্তৃক ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে বোঝানো হয়নি ডিজিটাল বাংলাদেশ কী ও কেন। তিনি বলেন, ‘এই এক বছরে সরকারের বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজকর্মে কাজ করার পুরনো পদ্ধতি পরিবর্তন করার কোনো পরিকল্পনা আছে বলে আমি শুনিনি। জাতীয় সংসদের কোনো কার্যক্রম ডিজিটাল করার কথা শুনিনি। এমনকি এই এক বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া নিয়ে টাস্কফোর্সের কোনো বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়নি।’
মোস্তফা জব্বার তার বক্তব্যে আরো বলেন, ‘স্কুলে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অথচ দেশের ২৮ হাজার স্কুলের জন্য প্রয়োজন ২৮ হাজার শিক্ষক। তবে কম্পিউটার শিক্ষাদানের জন্য এখনো ট্রেনিং দেয়া হয়নি ২৮ হাজার শিক্ষককে।’ হঠাৎ করেই এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষক কোত্থেকে আসবে, সরকারের প্রতি এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি। বাংলাদেশে থ্রিজি নেটওয়ার্ক এবং আইপি টেলিফোন এখনো না আসারও সমালোচনা করেন তিনি। তার মতে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় বিভিন্ন খাতে আরো বেশি ফোকাস করা প্রয়োজন। অন্যথায় সাধারণ মানুষের হাস্যরসের বিষয় হবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন তথ্য-প্রযুক্তিকে সকল খাতে প্রয়োগ করা। তিনি বলেন, দারিদ্র বিমোচন বর্তমান সরকারের সামনে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ। দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ বা ই-এডুকেশন চালু করা প্রয়োজন। এছাড়াও প্রতি বছর অধিক হারে আইসিটি গ্র্যাজুয়েট তৈরির কথাও বলেন তিনি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ সংক্রান্ত আইন সংস্কার করা, কম্পিউটার কাউন্সিল ঢেলে সাজিয়ে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা এটি পরিচালনার ব্যবস্থা করাসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি।
অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে সমালোচিত ‘সমন্বয়হীনতা’র কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ‘অজ্ঞতা’কে দায়ী করলেন হাসানুল হক ইনু। তার মতে, বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত হলেই কেবল সবকিছুতে সমন্বয় সাধন সম্ভব। এছাড়াও মোবাইল ফোন প্রযুক্তি সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হলে হ্যান্ডসেটের উপর ট্যাক্স কমানো এবং সিমকার্ডের উপর থেকে ট্যাক্স উঠিয়ে নেয়া প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
২০১০ সালে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মোবাইল ব্যাংকিং চালু, ডাক বিভাগকে আধুনিকীকরণ ও পোস্টম্যানদের বিনামূল্যে মোবাইলের সিমকার্ড দেয়াসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রমকে দৃঢ় করতে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
আলোচনায় আরেকটি বিষয় উঠে আসে তা হলো বিপুল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তোলা। অনেকেরই অভিমত, মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে না পারলে যতই প্রযুক্তি তুলে ধরা হোক না কেন, সাধারণ মানুষ তার সঠিক ব্যবহার করে লাভবান হতে পারবেন না। তাই সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম পূর্বশর্ত বলে দাবি করেন বৈঠকে উপস্থিত বক্তারা। শিক্ষিত হলে যে কেউই তথ্য-প্রযুক্তিকে দারিদ্র বিমোচনের কাজে লাগাতে পারবেন এবং দরিদ্রতা থেকে মুক্তি পাবেন। আর তখনই সফল হবে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন, “ডিজিটাল বাংলাদেশ”।

Custom Search
Check name compatibility at Love Calculator!
0 comments:
Post a Comment